*ফের বেড়েছে চাল-আটা-ছোলার দাম
*স্বস্তি খুঁজছে টিসিবির ট্রাকে
নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমাহীন সংকটে ফেলেছে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে। এসব মানুষ সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক ঘিরে স্বস্তি খুঁজছে। কিন্তু কখনও শ্রমসময় ব্যয় করে নিষ্ফল চেষ্টায়ও ভাঙা মন নিয়ে ফিরতে হয় নগরের অভাবীদের।
শনিবার বেলা ১১টার দিকে কমলাপুরের শাহজাহানপুর কলোনি টিসিবির ট্রাক ঘিরে দেখা গেছে নিত্যপণ্যের দামের প্রেষণে পিষ্ট শত শত মানুষ। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তারা। পুরুষের তুলনায় নারীদের লাইন দীর্ঘ।
লাইনে দাঁড়ানোদের মধ্যে শঙ্কা- তারা পাবেন তো তেল, ডাল, পেঁয়াজ ও চিনি। নাকি খালি হাতেই ফিরতে হবে। তাই সবাই যেন কিছুটা অসহিষ্ণু। বাজারে বিক্রি হওয়া দু-তিনগুণ বেশি দামের চারটি পণ্য সাশ্রয়ী দামে যে পেয়ে যান, তার মুখে থাকে বিজয়ীর হাসি।
এমনই বিজয়ী হাসি মুখে সামনে পড়লেন প্রতিবন্ধী শাহজাহান মিয়া। তিনি অন্ধ। শাহজাহান বলেন, ‘গত দুদিন লাইনে দাঁড়াইয়াও জিনিস পাইনি। মানুষ বেশি মাল কম। আইজ দুই ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাইক্যা পাইছি।’
তিনি বলেন, ‘আমি অন্ধ তাই কাজ করতে পারি না। বাসায় দুই মাইয়্যা, এক পোলা। বাচ্চাগো মা মানুষের বাসায় কাম করে। সব জিনিসের অনেক দাম। ঠিকমতো সংসার চলে না।’
লাইনে দাঁড়ানো সুলেখা বেগম বলেন, ‘স্বামী রিকশা চালায়, সব জিনিসের দাম বেশি। সংসার চালাইতে পারে না। আমরা সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পাই না। সকাল থাইক্যা লাইনে দাঁড়াইয়া রইছি। আমার পরে আরও ১৫-২০ জন রইছে। তারপরও ত্যাল-ডাইল পামু কি না জানি না।’
বেলা সাড়ে ১১টার দিকেই ট্রাকের পণ্য শেষ হয়ে যায়। হইচই করে ওঠেন লাইনে থাকা মানুষ। কোনো কারণ ছাড়াই ট্রাকটির পিছু ছুটতে থাকেন নারী-পুরুষরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রাকটি অদৃশ্য হয়ে যায়।
বর্তমানে টিসিবির ট্রাক থেকে জনপ্রতি ২ লিটার সয়াবিন তেল, ২ কেজি চিনি, ২ কেজি মসুর ডাল ও ৩-৫ কেজি পেঁয়াজ দেওয়া হচ্ছে। প্রতি লিটার তেল ১১০ টাকা, প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬৫ টাকা। প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকা রাখা হয়। বাজারে এই পণ্যগুলোর দাম কয়েকগুণ বেশি।
ফের বেড়েছে চাল-আটা-ছোলার দাম : কয়েক মাস ধরে চড়া দামে বিক্রি হওয়া চাল ও আটার দাম নতুন করে আরও বেড়েছে। রাজধানীর বাজারগুলোতে গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে তিন থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আটার দাম বেড়েছে কেজিতে চার টাকা পর্যন্ত। গত এক সপ্তাহে দাম বাড়ার তালিকায় আরও রয়েছে ময়দা, ছোলা, আদা, রসুন, শুকনা মরিচ।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীর দেওয়া তথ্যের পাশাপাশি এসব পণ্যের দাম বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যেও। তবে বাজারের প্রকৃত দামের সঙ্গে টিসিবির দামের কিছুটা তারতম্য রয়েছে।
খুচরা ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সরু চাল বা মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম কেজিতে তিন-ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে ৬২-৬৪ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া চিকন চালের দাম বেড়ে এখন ৬৬ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দাম বাড়ার এ তালিকায় রয়েছে মাঝারি ও মোটা চালও। মোটা চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৪ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৮-৫০ টাকা। মাঝারি মানের চালের দাম বেড়ে ৫৬-৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫৪-৫৬ টাকার মধ্যে।
তবে টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেড়ে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের কেজি এখন বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৭০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬০ থেকে ৭০ টাকা। মাঝারি মানের চালের ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৮ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। এছাড়া মোটা চালের দাম ২ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৬ থেকে ৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা।
খুচরা ব্যবসায়ীদের তথ্যানুযায়ী, এক সপ্তাহ আগে খোলা আটার কেজি ছিল ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা। গত এক সপ্তাহ দাম বেড়ে এখন খোলা আটার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকা। ৪২-৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া খোলা ময়দার দাম বেড়ে এখন ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।
আটা ও ময়দার বিষয়ে টিসিবি জানিয়েছে, এক সপ্তাহে খোলা আটার দাম ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৩৪-৩৬ টাকা। খোলা ময়দার দাম ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৭-৫০ টাকা। প্যাকেট ময়দার দাম ১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫২-৫৮ টাকা।
চালের দামের বিষয়ে মধ্যবাড্ডার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘কয়েকদিনে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। রশিদের চাল ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। এভাবে সব কোম্পানির চালের দাম বস্তায় ২০০-৩০০ টাকা করে বেড়েছে। এছাড়া আটা, ময়দার দামও গত কয়েকদিনে বেড়েছে।’
খিলগাঁও তালতলার ব্যবসায়ী জানে আলম ভুইয়া বলেন, ‘সব ধরনের চালের দাম বাড়তি। তবে মোটা চালের তুলনায় চিকন চালের দাম একটু বেশি বেড়েছে। কেজিতে চিকন চালের দাম পাঁচ-ছয় টাকা বেড়েছে। মোটা চালের দাম বেড়েছে দুই-তিন টাকা।’
রামপুরার ব্যবসায়ী মো. আল-আমিন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে চাল ও আটার দাম বাড়ছে। কিছুদিন আগে খোলা আটা ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। এখন যে দামে কেনা পড়ছে, তাতে ৪০ টাকার নিচে বিক্রি করার উপায় নেই। আটার মতো চালের দামেও কেজিতে চার-ছয় টাকা বেড়েছে।’
অন্যদিকে টিসিবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত এক সপ্তাহে খোলা পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, দারুচিনি, ধনিয়ার দাম বেড়েছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে খোলা পাম অয়েলের দাম দশমিক ৩২ শতাংশ, মসুর ডালে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, ছোলায় ১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আলুতে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, দেশি পেঁয়াজে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, আমদানি করা পেঁয়াজে ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ, দেশি রসুনে ২২ দশমিক ২২ শতাংশ, আমদানি করা রসুনে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, দেশি শুকনা মরিচের ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, আমদানি করা শুকনা মরিচে ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ, আমদানি করা হলুদে ৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, দেশি আদার ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, দারুচিনির ২ দশমিক ২৭ শতাংশ এবং ধনিয়ার ৮ শতাংশ দাম বেড়েছে।